নির্বাচনের ইতিবৃত্ত

৭ জানুয়ারি ২০২৪ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অনুসর্গ নির্বাচন। আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিক ভোট প্রদানের মাধ্যমে বেছে নেন তাদের পছন্দের নেতৃত্ব। কিন্তু নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। নির্বাচন কেন, কিভাবে এল, কোথায় এর সূচনা এ প্রসঙ্গে আমাদের জানা প্রয়োজন।

আপনি যদি নির্বাচনের ইতিবৃদ্ধ জানতে চান তাহলে আজকের এই পর্বটি সম্পন্ন পড়ুন তাহলে আপনি জানতে পারবেন নির্বাচনের সুদীর্ঘ ইতিহাস। চলুন তাহলে দেরি না করে জেনে নেই বিস্তারিত আলোচনা।

নির্বাচন 

নির্বাচন হল কোন দেশ, প্রতিষ্ঠান বা দপ্তরের কোনো পদে প্রার্থীদের মধ্য থেকে এক বা একাধিক প্রার্থীকে বাছাই করার প্রক্রিয়া। অর্থাৎ নির্বাচন হচ্ছে জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের পদ্ধতি। স্থানীয় পরাজয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে পর্যন্ত ভোটাধিকার প্রাপ্ত সকল নাগরিক ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি বাছাই করে। সুষ্ঠু নির্বাচন গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির অন্যতম শর্ত। 

ভোট 

ভোট কোন সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা প্রতিনিধি নির্বাচনের উদ্দেশ্যে সভা, সমিতি বা নির্বাচনে এলাকায় মতামত প্রকাশের একটি মাধ্যম বা পদ্ধতি। সাধারণত আলোচনা, বিতর্ক বা নির্বাচনী প্রচারণার পর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ দায়িত্ব লাভ করেন। ভোট দানের অধিকার সম্পূর্ণ ব্যক্তিদের বলা হয় ভোটার।

নির্বাচনের সূচনা 

শাসন কাঠামো পরিচালনায় গ্রীকরায় সর্বপ্রথম নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলন করেন। প্রথমদিকে লটারির মাধ্যমে তারা তাদের শাসক বেছে নিতো। প্রাচীন রোমেও নির্বাচনের ব্যবহার ছিল।সমগ্র মধ্যযুগের রোমান সম্রাট ও পোপ বাছায়ের ক্ষেত্রেও নির্বাচনের ব্যবহার দেখা যায়। সুদূর অতীতে শাসন প্রক্রিয়া প্রচলিত ছিল পরিবার তন্ত্র বা উত্তরাধিকার নীতি। সৃষ্টের জন্মের ৭৫৪ বছর আগে প্রাচীন গ্রিসের স্পার্টার মিশ্র সরকারের অধীনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ের নীতিনির্ধারণী বোর্ডের ৫ সদস্য বাছাইয়ের জনগণের সম্পৃক্ততায় নির্বাচনের নাজির পাওয়া যায়। 

প্রাচীন ভারতে নির্বাচন 

ভারতীয় সমাজে বৈদিক যুগে নির্বাচনে প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। বৈদিক যুগে ভারতের ‘গণ’ নামক সংগঠন রাজা নির্বাচন করত।দশম শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতের চোল সাম্রাজ্যের উঠিরামেরু তথা বর্তমান তামিলনাড়ুতে পাম গাছে পাতায় ভোটদানের মাধ্যমে গ্রাম পরিষদের সদস্য নির্বাচন করা হতো। একজন ভালো কে গ্রাম পরিষদের যতজন সদস্য ততটি পাতা তুলতে বলার মধ্যে দিয়ে প্রাথী নির্বাচন করা হতো। এ ব্যবস্থাকে বলা হত কুডাভোলা।

ভারতে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার পর উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে শাসন কার্য পরিচালিত হলেও স্থানীয় শাসকের বিভিন্ন প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ছিল জনগণের । সম্রাট জেলা পর্যায়ে ফৌজদার ও অপরাপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ করতে এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হতেন। ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত প্রচলিত গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচন ধর্মে বৈশিষ্ট্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৭৯৩ সালের লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক অনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়। 

আধুনিক বিশ্বে নির্বাচন 

আধুনিক বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয় ক্রয়দ শতকে ইংল্যান্ডের সদস্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে। এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৬৪১ Triennial Art ও ১৭১৬ সালের Septennial Act এর মাধ্যমে স্থায়ী রূপ দেওয়া হয়। ১৮৭২  সালের গোপনে বেল্টের মাধ্যমে ভোট প্রদানের পদ্ধতি প্রণীত হয়। 

বাংলায় নির্বাচন 

উনিশ শতকের ৭০ ও আশির দশকে বাংলায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে পঞ্চায়েত  ব্যবস্থা প্রচলন ছিল। পঞ্চায়েত প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে প্রাচীন নির্বাচন ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে।১৪৬৮ সালে পৌর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দুই  - তৃতীয়াংশ নির্বাচিত এবং এক -তৃতীয়াংশ মনোনীত সদস্যের সম্মেলনের পশ্চাত্য ধরনের তোর ও কমিটি গঠনের বিধান প্রবর্তন করা হয়। শুধু পৌর ও করদাতাদেরই সদস্য নির্বাচিত করার অধিকার ছিল।

 ১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইনের আয়তায় কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক উভয় আইন সভায় নির্বাচনের বিধান প্রবর্তন করা হয়। ১৯২০ সাল থেকে অনিয়মিতভাবে হলেও পৃথক নির্বাচনের উপর ভিত্তি করে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রদেশের পরিষদের নির্বাচন তখনও সর্বজনীন না হলেও সেখানে ব্যাপকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় প্রদেশিক আইন পরিষদের সর্বজনীন ভোটাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১১ টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ই মার্চ ১৯৭৩। পরবর্তী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ জানুয়ারি ২০২৪। 

নারীর ভোটাধিকার 

গোপন ব্যালট পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলনের পর পুরুষই একমাত্র ভোট প্রদানের অধিকার রাখতো। ২৮ নভেম্বর ১৮৯৩ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের নিউজিল্যান্ডের নারীরা সর্বপ্রথম ভোট প্রদান করে। সেটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে নারীদের ভোটদার প্রথম ঘটনা। এরপর ১৯১৭ সালে রাশিয়া,১৯১৮ সালে ইংল্যান্ড ও জার্মানি, ২৬ আগস্ট ১৯২০ যুক্তরাষ্ট্র এবং ১৯৪৪ সালে ফ্রান্স নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে। এরপর ক্রমান্বয়ে বিশ্বের প্রায় সকল দেশের নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়। 

ভোট দেওয়ার বয়স 

নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার পর থেকে ভোট দেওয়ার মার্জিন বয়স ছিল ২১ বছর এবং সেনাবাহিনীতে নিয়োগ নূন্যতম বয়স ছিল ১৮ বছর। ১৯৭১ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালে মার্কিন নাগরিকরা উপলব্ধি করে যে একজন নাগরিক যে বয়সে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারে , সে বয়সটি তার ভোট দেওয়ার জন্য উপযুক্ত সময়।ফলে সংবিধানের ২৬ তম সংশোধনীর মাধ্যমে ভোট দেওয়ার বয়স ১৮ করা হয়। বিশ্বে ভোট ব্যবস্থা চালু রয়েছে এমন দেশগুলোতে এখন ১৮ বছর হলে নাগরিকরা ভোটদার অধিকার লাভ করে। 

বাধ্যতামূলক ভোট 

বেলজিয়াম বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র যারা ১৮৯২ সালে পুরুষদের জন্য এবং ১৯৪৯ সালে নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক ভোটের ব্যবস্থা চালু করে। এছাড়াও যেসব দেশে এ আইন রয়েছে সেগুলো হলঃআর্জেন্টিনা, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, বালিভিয়া, ব্রাজিল, মিশর, গ্রীস,ইতালি, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড আরো কয়েকটি দেশ। 

শেষ কথা

প্রিয় পাঠক আজকে আমরা এই আর্টিকেলের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আশা করছি আপনারা এই আর্টিকেলটি খুব মনোযোগ সহকারে পড়েছেন এবং জানতে পেরেছেন নির্বাচনের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে। আজকের এই আর্টিকেল যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই আপনি আপনার বন্ধু বান্ধবের সামনে শেয়ার করতে ভুল করবেন না।


পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url